সিরিয়ার
ইদলিব কিংবা লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি। ইউক্রেনের খারকিভ অথবা আজারবাইজানের ফুজুলি।
সবখানেই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে
বিশেষ এক ধরনের ড্রোন।
কথা না বাড়িয়ে স্পষ্টভাবে
বললে তুরস্কের তৈরি ড্রোন বায়রাকতার
টিবি-২। একসময় ইউরোপের
রুগ্ন মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো
তুরস্ককে। কিন্তু সেই তুরস্ক গত
এক দশকে সামরিক এবং
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য
উচ্চতায়। তুরস্কের এই ক্রমবর্ধমান সামরিক
অগ্রগতির পোস্টার হতে পারে যে
বস্তুটি, তা হলো ড্রোন।
প্রেক্ষাপট
মাত্র
দেড় দশক আগেও ড্রোন
ক্রয়ের জন্য ইসরায়েল এবং
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দিতে
হতো
তুরস্ককে।
তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দী বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য
ড্রোনের ব্যাপক দরকার ছিল তুর্কি সেনাবাহিনীর।
কুর্দীদের ঘাঁটিগুলো বেশিরভাগ ছিল পার্বত্য অঞ্চলে।
আর দুর্গম এসব পার্বত্যাঞ্চলে স্থলপথে
অভিযান চালিয়ে সাফল্য পাওয়া যেতো কম। সে
সময় ড্রোন প্রযুক্তিতে ইসরায়েল এবং আমেরিকার ড্রোন
সবচেয়ে অগ্রসর ছিল। ইসরায়েল থেকে
বেশ কয়েকবার ড্রোন ক্রয় করে তুরস্ক।
কিন্তু প্রতিবারই ইসরায়েল নানা ছুঁতোয় ড্রোন
সরবরাহ করতে দেরি করতো।
এছাড়া তুরস্কের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট বলে, তুরস্ক যখন
কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর হামলার প্রস্তুতি
নিত, আগেভাগেই খবর জেনে কুর্দি
বিদ্রোহীদের পালাতে সহায়তা করতো ইসরায়েল। এই
ড্রোনের অভ্যন্তরীণ মেকানিজম, কন্ট্রোল স্টেশন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইসরায়েলের এমন
দ্বিচারিতার জন্য তুরস্ক ভালোভাবে
কুর্দি বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম
হচ্ছিল না। এমন সংকটময়
পরিস্থিতিতে তুরস্কের জন্য ত্রাণকর্তা হয়ে
আসেন একজন তুর্কি তরুণ।
তিনি তুরস্কের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বায়রাকতার ড্রোনের রূপকার সেলজুক বায়রাকতার।
ড্রোন
নির্মাতার পরিচয়
সেলজুক
বায়রাকতার ১৯৭৯ সালে তুরস্কের
ইস্তাম্বুলের সারইয়ের জেলার একটি তুর্কি মুসলিম
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম
ওজদেমির বায়রাকতার এবং মায়ের নাম
জানান বায়রাকতার। ওজদেমির ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং
তার নিজস্ব কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’ তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়ির যন্ত্রাংশ
তৈরি করতো। ওজদেমিরের তিন সন্তানের মধ্যে
সেলজুক বায়রাকতার ছিলেন মধ্যম। সারইয়ের প্রাইমারি স্কুলে অধ্যয়নের মধ্যদিয়ে বায়রাকতারের শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয়। ১৯৯৭ সালে
তিনি ইস্তাম্বুল আমেরিকান রবার্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি
ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে থাকা
অবস্থায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য একটি বৃত্তি
লাভ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে
গমন করেন। ২০০৪ সালে তিনি
সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি
অর্জন করেন। সেখানে অধ্যয়নরত থাকাকালেই তিনি বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস
ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)
অধ্যয়নের জন্য আরেকটি বৃত্তি
লাভ করেন এবং সেখানে
অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্স বিভাগে একজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট
হিসেবে যোগদান করে সেখান থেকে
আরেকটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নকালে ড্রোন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেলজুক
বায়রাকতার এবং এই বিষয়ে
তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। ২০০৩ সালে পেন্সিলভেনিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি ভূমিতে অবস্থিত
রোবট টিমের সঙ্গে আকাশে উড়ন্ত ড্রোনবহরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করেন। এটি
ছিল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ড্রোন ও
রোবটের এয়ার-গ্রাউন্ড কো-অর্ডিনেশন। এমআইটিতে থাকাকালেও তিনি এ বিষয়ে
নতুন নতুন কৃতিত্ব অর্জন
করতে থাকেন। এ সময় তিনি
চালকবিহীন হেলিকপ্টার সিস্টেমকে আগ্রাসীভাবে চালনা করার বিষয়ে গবেষণা
করেন এবং কন্ট্রোলস ইঞ্জিনিয়ারিং
সংক্রান্ত বিভিন্ন শীর্ষ জার্নালে তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত
হয়।
ড্রোনযুগের
সূত্রপাত
১৯৯৫
সালে তুরস্ক প্রথম ‘ড্রোন যুগে’ প্রবেশ করে। কিন্তু এ
সময় তুরস্কের কোনো নিজস্ব ড্রোন
প্রকল্প ছিল না এবং
তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল থেকে
আমদানিকৃত ড্রোনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
কিন্তু দেশ দুটি তুরস্ককে
এই প্রযুক্তি দিতে গড়িমসি করে,
ইচ্ছাকৃতভাবে চালান পাঠাতে দেরি করে এবং
ত্রæটিযুক্ত ড্রোন পাঠায়। এছাড়া বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিত
যাতে তুর্কিরা এটি স্বাধীনভাবে পরিচালনা
করতে না পারে। তুর্কিরা
মার্কিন নির্মিত ‘এঘঅ ৭৫০’ ড্রোন
ব্যবহার করে ইরাক ও
সিরিয়া সীমান্ত বরাবর পিকেকে সন্ত্রাসীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতো, কিন্তু ড্রোন থেকে প্রাপ্ত ভিডিও
বিশ্লেষণ করে অভিযান পরিচালনার
আগেই পিকেকে গেরিলারা সেখান থেকে সটকে পড়তো।
এছাড়া তুর্কি কর্মকর্তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরবরাহকৃত ড্রোনগুলোয় অন্তর্ঘাত চালানোরও অভিযোগ করেন। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার
ফলে তুরস্ক সরকার নিজস্ব ড্রোন নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে। ২০০৪
সালে ‘টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই)’কে এই দায়িত্ব
প্রদান করা হয়। কিন্তু
টিএআই-এর প্রকল্প ছিল
প্রলম্বিত এবং প্রাথমিকভাবে ব্যর্থতায়
পরিপূর্ণ। এর মূল কারণ
ছিল তুর্কি সামরিক কর্মকর্তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরির চেয়ে বিদেশ থেকে
আমদানি করার মানসিকতা। এদিকে
টিএআই যখন নিজস্ব প্রযুক্তিতে
ড্রোন তৈরির আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, সে সময় ২৬
বছর বয়সী সেলজুক বায়রাকতার
নিজের তৈরি একটি ড্রোনের
জন্য তুর্কি সরকারের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা শুরু করেন। ২০০৫
সালে তিনি একটি বিমানঘাঁটিতে
একদল তুর্কি সরকারি কর্মকর্তার সামনে তার নিজের তৈরি
একটি ক্ষুদ্র ড্রোন প্রদর্শন করেন। সেখানে তিনি দেখান যে,
তার তৈরি করা ড্রোনটি
কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই উড্ডয়ন এবং অবতরণ করতে
সক্ষম। বায়রাকতার তার তৈরি ড্রোনটি
প্রদর্শনের পর উপস্থিত তুর্কি
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে একটি ছোট বক্তৃতা
দেন। তিনি বলেন, ‘আমার
অনেক বন্ধু বিভিন্ন মার্কিন সামরিক প্রকল্পের জন্য বৃত্তি পেয়ে
কাজ করছে। কিন্তু তুরস্কে ফেরার পর আমি কিসের
ওপর কাজ করব?’ তিনি
আরো বলেন, ‘বোয়িং, লকহিড, এগুলো বড় কোম্পানি। আমরাও
একই রকম সিস্টেম তৈরি
করছি। যদি তুর্কি সরকার
এই প্রকল্পে সমর্থন দেয়, পাঁচ বছরের
মধ্যে তুরস্ক ড্রোনের ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে!
বায়রাকতারের
বক্তব্য ছিল চমকপ্রদভাবে আত্মবিশ্বাসী
এবং বেপরোয়া। তিনি চাচ্ছিলেন, তার
পারিবারিক কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’কে তুর্কি সরকার
সামরিক ড্রোন নির্মাণের অনুমতি প্রদান করুক। কিন্তু তুর্কি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তখন বায়রাকতার
পরিচিত ছিলেন না। তুর্কি আমলাতন্ত্র
মেরিটোক্রেসির পরিবর্তে আনুগত্যের ভিত্তিতে এ ধরনের কন্ট্রাক্ট
প্রদান করতো। ফলে প্রাথমিকভাবে অচেনা
এই এমআইটি পড়ুয়া তরুণের বক্তব্য তুর্কি আমলাদের ওপর প্রভাব ফেলেনি।
অবশ্য ২০০৬ সালে তুর্কি
সেনাবাহিনীর ড্রোন নির্মাণের একটি প্রতিযোগিতায় বায়রাকতার
বিজয়ী হন এবং এরপর
বায়রাকতারের কোম্পানিকে তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্য ১৯টি মিনি
ড্রোন তৈরির কাজ দেওয়া হয়।
এই কাজটি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করার
ফলে তুর্কি কর্মকর্তাদের মধ্যে কোম্পানিটি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয় এবং তার
পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বায়রাকতারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি
করে দেয়।
২০১০
সালে গাজা ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ জাহাজের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের
ফলে কয়েকজন তুর্কি নাগরিক নিহত হন। এই
ঘটনা তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্কে চরম প্রভাব ফেলে।
তুর্কি-ইসরায়েলি দ্ব›দ্বকে কারণ
হিসেবে দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছে ড্রোন বিক্রি
করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই অবস্থায় তুরস্ক
বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস
করার উদ্দেশ্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে ড্রোন নির্মাণের প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়ার
সিদ্ধান্ত নেয়। তুরস্কের তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত
করেন। এটি বায়রাকতারের জন্য
সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। কারণ,
সামরিক ড্রোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার উৎসাহ ও
যোগ্যতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
বায়রাকতার বরাবরই ড্রোন প্রযুক্তির জন্য বিদেশের ওপর
তুর্কিদের নির্ভরশীলতার বিপক্ষে ছিলেন এবং এই বিষয়ে
তার বক্তব্যগুলো তাকে তুর্কি জনসাধারণের
মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। ২০১৫
সালে বায়রাকতার একটি বিরাট সাফল্য
অর্জন করেন। একটি প্রদর্শনীতে তার
কোম্পানির তৈরি ‘বায়রাক্তার টিবি-২’ ড্রোন
ভূমি থেকে ১৬,০০০
ফুট উচ্চতায় থেকে পরীক্ষামূলকভাবে একটি
রকেট নিক্ষেপে সক্ষম হয়। এটি ছিল
তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র ড্রোনের উড্ডয়ন এবং স্বভাবতই তুর্কি
প্রচারমাধ্যম ও সশস্ত্রবাহিনীর কাছ
থেকে এটি ব্যাপক প্রশংসা
অর্জন করে। বায়রাকতার রাতারাতি
তুর্কি ‘জাতীয় বীরে’ পরিণত হন। সেলজুক বায়রাকতারের
ভাষায়, বায়রাকতার ড্রোন যা করার দরকার
সেটাই করে দেখাচ্ছে। সবচেয়ে
অত্যাধুনিক বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, আর্টিলারি ও সাঁজোয়া যান
নিমিষেই ধ্বংস করছে।
ড্রোনের
রকমফের ও বৈশিষ্ট্য
তুরস্কে
নির্মিত ড্রোনের প্রধান উৎপাদনকারী সংস্থা হচ্ছে দুটি। বায়কার ডিফেন্স নামের প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করে বায়রাকতার
টিবি-২ ও
বায়রাকতার আকিনচি। আরেকটি বড় উৎপাদনকারী সংস্থা
‘টার্কিশ এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’। এদের তৈরি
ড্রোনের নাম টিএআই আংকা
এবং টিএআই আকসুংগুর। বায়রাকতার টিবি-২ মাঝারি
উচ্চতার টেকসই ড্রোন। একেকটি ড্রোনের মূল্য ২০ লাখ ডলার।
ড্রোনটি দৈর্ঘ্য সাড়ে ৬ মিটার
প্রস্থ ১২ মিটার। এটি
কন্ট্রোল স্টেশন থেকে পরিচালনা করা
হয়। ড্রোনটি ২৭ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ
৮ হাজার মিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। ৭০০
কেজি ওজন নিয়ে উড়তে
পারা বায়রাকতার টিবি-২ এর
সর্বোচ্চ লোড ক্যাপাসিটি ১৫০
কিলোগ্রাম। এতে রয়েছে ১০০
হর্সপাওয়ার বিশিষ্ট সিঙ্গেল ইঞ্জিন। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২২০
কিলোমিটার। এই ড্রোনে একটি
অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল ক্যামেরা আছে। তার সাথে
আছে ডাটা-লিংক সিস্টেম
এবং দুই থেকে চারটি
পর্যন্ত বিস্ফোরক - যা প্রিসিশন-গাইডেড
অর্থাৎ উড়ে গিয়ে নির্ভুল
নিশানায় লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে।
এর ফলে এটা দিয়ে
আগে থেকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ
করা যায় এবং তার
পর দিক নির্ণয় করে
চলতে সক্ষম বোমা দিয়ে তাদের
ওপর আঘাত হানা যায়।
এটি জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ-মূল কমান্ড
সেন্টার থেকে দূরে কোথাও
একটি কন্টেইনার বা ট্রাকে মোবাইল
বেজ স্থাপন করে সহজে ড্রোন
পরিচালনা করা যায়। ফলে
মিশনের প্রয়োজনে যেকোনো স্থানে গিয়ে ড্রোন উড্ডয়ন
বা হামলা চালানো যায়।
‘বায়রাকতার
আকিনচি’ ড্রোন তৈরির কথা প্রথম শোনা
যায় ২০১৮ সালে। এটি
প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে।
সে বছর তুরস্কের টেকনোফেস্ট
নামক মহাকাশ, বিমান এবং টেকনোলজি ফেস্টিভ্যালে
প্রথম প্রদর্শন করা হয় এই
ড্রোন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সেখানে আকিনচির গায়ে প্রথম স্বাক্ষর
করেন। সে বছর ডিসেম্বর
মাসে এটি প্রথম পরীক্ষামূলক
উড্ডয়ন সম্পন্ন করে। তুরস্কের এই
মনুষ্যহীন যুদ্ধ ড্রোনটি তার ২০ মিটারের
চওড়া ডানায় ভর করে উড়ার
সময় ১৩৫০ কিলোগ্রাম স্মার্ট
গোলাবারুদ বহন করতে পারে।
আকিনচি হচ্ছে ৪০ হাজার ফুট
উচ্চতায় এয়ার টু এয়ার
আট্যাক করার ক্ষমতাসম্পন্ন তুরস্কের
প্রথম কোনো ড্রোন। ২০১৯
সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক
উড্ডয়ন সম্পন্ন করে এটি। এর
পর তার দ্বিতীয় এবং
তৃতীয় প্রোটোটাইপ বহুবার বিভিন্ন পর্যায়ে উড্ডয়ন সম্পন্ন করে। তখন থেকে
ধাপে ধাপে বিকশিত হতে
থাকে আকিনচি। সফটওয়্যার থেকে ইলেকট্রনিক্স এভিওনিক্স
থেকে অস্ত্র সিস্টেম পর্যন্ত প্রতিনিয়তই বাড়তে থাকে এর কার্যক্ষমতা।
অবিশ্বাস্য উচ্চতায় উড্ডয়ন এবং টার্গেটে নিখুঁতভাবে
আঘাত করাসহ নতুন নতুন রেকর্ড
করে এগিয়ে চলতে থাকে আকিনচির
বিকাশ।
যুদ্ধক্ষেত্রে
সাফল্য
সিরিয়া:
বায়রাকতারের তৈরি ড্রোন বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। এই ড্রোনটি তুর্কি-ইরাকি ও তুর্কি-সিরীয়
সীমান্ত বরাবর সক্রিয় পিকেকে সদস্যদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে এবং
বহু পিকেকে সন্ত্রাসী এর হামলায় নিহত
হয়েছে। এই ড্রোনটির ব্যবহার
শুরু হওয়ার পর থেকে পিকেকে
সদস্যদের পক্ষে বড় কোনো দলে
চলাফেরা করা বিপজ্জনক হয়ে
দাঁড়িয়েছে। বায়রাকতার ড্রোনের প্রথম বড় পরীক্ষা ও
ব্যবহার হয়
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। ২০২০ সালের শুরুর
দুই মাসে রাশিয়ার সমর্থনে
এবং ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সিরিয়ার আসাদ সরকার তুরস্ককে
বেশ বেকায়দায় ফেলে। তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহীদের একমাত্র শক্ত ঘাঁটি ইদলিবে
হামলা করে আসাদ বাহিনী।
এতে ইদলিবে অবস্থানরত তুরস্কের অনেক সেনাসদস্য আহত
ও নিহত হন। যদিও
বাস্তবিক অর্থে তুরস্ককে মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা
আসাদ সরকারের নেই। তারা এই
দুঃসাহস দেখায় রাশিয়ার মদদে। রাশিয়া ও ইরানের সহায়তা
পেয়ে আসাদ বাহিনী বেশ
সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। যার কারণে
তাদের আত্মবিশ্বাস খুব বেড়ে যায়।
আসাদের সৈন্যদল তুরস্কের ৩৬ জন সেনাকে
হত্যা করে বসে। এরপরই
মাঠে নামানো হয় তুরস্কের ড্রোন
বায়রাকতার টিবি-২। এই
ড্রোনের বিধ্বংসী আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সিরিয়ার
আসাদ সরকারকে। তুরস্ক বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন
দিয়ে সিরিয়ার সেনা বাহিনীর সামরিক
মেরুদÐ ভেঙ্গে দেয়। এই অভিযানে
সিরিয়ার দেড়শতাধিক ট্যাংক, ৪৭ টা হাউৎজার,
৫২টা রকেট লঞ্চার, ২৪টা
সাঁজোয়া যান, ২৭টি অস্ত্রবাহী
যুদ্ধযানসহ অসংখ্য সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হয়। পাশাপাশি সিরিয়ার
৩ জন জেনারেল নিহত
হন ড্রোন হামলায়। তুরস্কের কাছে সিরিয়া তার
সামরিক সক্ষমতার পাঁচ ভাগের একভাগ
হারায়।
লিবিয়া:
তুরস্কের নিকটপ্রতিবেশীর বাইরে বায়রাকতার ড্রোনের প্রথম বড় অপারেশন হয়
লিবিয়ার মাটিতে। লিবিয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের সাথে ২০১৯ সালে
চুক্তি সম্পন্ন করে তুরস্ক। তুরস্কের
সাথে চুক্তি করার সময় জিএনএ
সরকার পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিল। সেজন্য লিবিয়ার
আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রæতি দেয় তুরস্ক।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি দখলের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। রাজধানী
থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে
অবস্থান করছিল হাফতার বাহিনী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল জিএনএ
সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার
মাত্র। কারণ জিএনএ সরকারের
হাতে রাজধানী ছাড়া আর তেমন
গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু
তখন শুরু হয় বায়রাকতার
ড্রোনের খেলা। রাজধানীর সীমানা থেকে হাফতার বাহিনীকে
তো বিদায় করা হয়, পাশাপাশি
লিবিয়ার বৃহত্তম বিমানঘাঁটি আল ওয়াতিয়া এয়ারবেজ,
সমগ্র পশ্চিম উপক‚ল নিজেদের
নিয়ন্ত্রণে আনে জাতিসংঘ স্বীকৃতি
জিএনএ সরকার। লিবিয়ার ড্রোন হামলায় ব্যাকফুটে চলে যায় হাফতারের
এলএনএ বাহিনী। তুর্কি ড্রোন হাফতার বাহিনীর থাকা ৭টা পান্টসির
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করে। হাফতার বাহিনীর
অধীনে কাজ করা রাশিয়ান
ভাড়াটে সেনা ওয়াগনার গ্রæপকে অকার্যকর করা
হয়।
আজারবাইজান:
তুর্কি ড্রোনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালিত হয় আজারবাইজানের নাগার্নো
কারাবাখ অঞ্চলে। আর্মেনিয়ার হাত থেকে এই
অঞ্চল উদ্ধার করতে আজারবাইজানকে সরাসরি
সহায়তা করে তুরস্ক। ১৯৯০
এর দশক থেকে আর্মেনিয়া
অবৈধভাবে আজারবাইজানের নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল দখল করে রেখেছিল।
প্রথম
কারাবাখ যুদ্ধে (১৯৯০-১৯৯৪) আর্মেনিয়ার
কাছে বিপুল এলাকা হারায় আজারবাইজান। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ
আজেরি জনগণ উচ্ছেদ হয়।
আর্মেনিয়া সেখানে অবৈধ দখলদারিত্ব কায়েম
করে। আজারবাইজান দীর্ঘদিন যাবত নিজের সামরিক
শক্তি বৃদ্ধি করছিল হারানো এলাকা ফিরে পাওয়ার জন্য।
অবশেষে কাঙিক্ষত সময় এসে গেল।
২০২০ সালের শেষের দিকে সংগঠিত হয়
আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যকার
দ্বিতীয় যুদ্ধ। দেড় মাস দীর্ঘ
এই যুদ্ধে ভূমিধস বিজয় লাভ করে
আজারবাইজান। তুর্কি ড্রোনের সহায়তায় আর্মেনিয়ার এস-৩০০, স্যাম
ডিফেন্স সিস্টেমসহ অসংখ্য সামরিক সরঞ্জাম ও স্থাপনা ধ্বংস
করা হয়। আর্মেনিয়ার সামরিক
বাহিনীর মেরুদÐ ভেঙ্গে যায়। আজেরি ড্রোনের
সামনে তারা কোনো প্রতিরোধই
সৃষ্টি করতে পারেনি। আজারবাইজানের
এই বিজয়ের পেছনে প্রযুক্তিগত দিক থেকে শতভাগ
ক্রেডিটই চলে যায় তুর্কী
ড্রোন বায়রাকতারের কাছে। এই যুদ্ধের সময়
বায়রাকতার ড্রোন দিয়ে আর্মেনিয়ান সৈন্যদের
মারার দৃশ্যগুলো অনেকটা ভিডিও গেমসের মতনই নেট দুনিয়ায়
ভাইরাল হয়। তখন থেকেই
মূলত তুর্কি ড্রোনের চাহিদা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাড়তে থাকে।
ইউক্রেন:
রাশিয়া অল্প কিছু দিনের
মধ্যে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখল
করে নেয়। কিন্তু ইউক্রেন
তার হাতে থাকা অন্যান্য
যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন
দিয়ে খারকিভ থেকে রাশিয়াকে তাড়িয়ে
দেয়। বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন
ব্যবহার করে রাশিয়ার আর্টিলারি
সিস্টেম, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান
ধ্বংস করে ইউক্রেন। পরবর্তীতে
এই ড্রোন ব্যবহার করেই রাশিয়ার ফ্ল্যাগশিপ
মস্কোভা যুদ্ধজাহাজ, অস্ত্রের গুদাম, কমান্ড সেন্টার ও রাশান লক্ষ্যবস্তুতে
হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনে বায়রাকতার
ড্রোন এতই জনপ্রিয় হয়
যে, এটি নিয়ে গান
বানিয়ে ফেলে ইউক্রেনের সেনারা।
পশ্চিমাদের বড় ধরনের সামরিক
সহায়তা আসার আগ পর্যন্ত
ড্রোন ছিল ইউক্রেনের অন্যতম
কার্যকর অস্ত্র। রাশিয়ার সমরাস্ত্র ও বহরের ওপর
হামলা করে ইউক্রেন তাদেরকে
ঠেকিয়ে দেয়। ইউক্রেনের সাথে
স¤প্রতি বায়রাকতার আকিনচি ড্রোন দেওয়ার ব্যাপারে চুক্তি করেছে বায়কার কোম্পানি। টিবি-২ এর
চেয়ে আকিনচি অনেক বেশি শক্তিশালী
ও কার্যকর। এই ড্রোন ইউক্রেনকে
রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে
অনেক বেশি সহায়তা করবে।
ভবিষ্যত
পরিকল্পনা
বায়রাকতার
টিবি-২ ও বায়রাকতার
আকিনচির সাফল্যের প্রেক্ষাপটে বায়কার কোম্পানি আরো উন্নত ‘বায়রাকতার
টিবি ৩’ কমব্যাট ড্রোন
নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। যাকে
বলা হচ্ছে ড্রোন জগতের বড় ভাই। ড্রোনের
পাশাপাশি তুরস্ক আনম্যানড ফাইটার জেট খিজিল এলমা
এর প্রটোটাইপ ইঞ্জিন সেট করেছে। প্রথম
প্রোটোটাইপে ইঞ্জিন সফলভাবে চালু করেছে। সেপ্টেম্বরে
এই পরীক্ষার ভিডিও বায়কার কোম্পানি শেয়ার করেছে। প্রায় ৫৫০০ থ্রাস্ট লোডের
এই ইঞ্জিন ইউক্রেন থেকে নিচ্ছে তুরস্ক।
তবে এই টার্বোশ্যাফ্ট ইঞ্জিন
তুরস্ক আগামী বছরখানেকের মধ্যে তৈরি করবে। তুর্কি
ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ড্রাস্ট্রি (ঞঊও) এই ইঞ্জিন
তৈরি করছে। আগামী ডিসেম্বরে খিজিল এলমা ফার্স্ট টেস্ট
ফ্লাই করার পরিকল্পনা করেছে
বায়কার কোম্পানি। খিজিল এলমা আসলে তুরস্কের
হার্ডপাওয়ার বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।
লেখক: আনয়ারুল আজিম
Leave a reply