প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আনোয়ার ইব্রাহিমের। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও মসনাদ থেকে জায়গা হয় জেলে। হওয়ার কথা ছিলো মালয়েশিয়ার পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছাত্রনেতা হিসেবে রাজপথের প্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া মাহাথির মোহাম্মাদ (১৯৮১) বিমুগ্ধ হয় তার নেতৃত্বগুনে। মালয়েশিয়ার প্রাচীন দল আমনুতে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করলে মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে ১৯৮২ সালে যোগদেন সরকারী দলে। ১৯৮৩ সালে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষি মন্ত্রী, ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী ও ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব গুনে ১৯৯৩ সালে দলে মাহাথির মোহাম্মাদের ডেপুটি নির্বাচিত হলে একই বছরে অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মাদের রানিংমেট হন তিনি।
১৯৯৭ সালের মে মাসে
মাহাথির মোহাম্মাদ দুই মাসের ছুটিতে গেলে তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব
দেন। দায়িত্ব পেয়ে দল ও সরকারের বিভিন্ন দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে সোচ্চার
হলে মাহাথির মোহাম্মাদ ও দলে বিরাগভাজনের স্বীকার হন তিনি। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালের
২রা সেপ্টেম্বর বহিস্কৃত হন মন্ত্রী পরিষদ থেকে। বন্দী হন ২০শে সেপ্টেম্বর।
বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তার সমর্থকেরা। সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় যা পরবর্তী রাজনৈতিক দল
কেদিলানে পরিণত হয়। যাইহোক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় দূর্নীতি ও সমকামিতার। জেল
হয় পাঁচ বছরের। ২০০৪ সালে সমকামিতার অভিযোগ থেকে মুক্তি পায়। মালয়েশিয়ার আইন
অনুযায়ী দোষী কেউ সাজা শেষে পাঁচ বছর রাজনীতি করতে পারে না। ফলে এই সময় তিনি
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন।
অন্যদিকে ২০০৩ সালে
তার স্ত্রী ওয়ান আজিজার নেতৃত্বে কেদিলান থেকে পিকেআরে রুপ নেয় তার দল। সাজার পাঁচ
বছর পরে রাজনীতিতে আসার ঘোষনা দেন ২০০৬ সালে। সে যাতে নির্বাচন না করতে পারে
সেজন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০০৮ সালে নির্বাচন ঘোষণা করে সরকার। পরে তার স্ত্রী
পিকেআর চেয়ারম্যান ও মালয়েশিয়ার ইতিহাসে প্রথম মহিলা বিরোধীদল নেত্রী এমপি পদ থেকে
পদত্যাগ করে তাকে নির্বাচিত করে ২০০৮ সালের ২৮শে আগস্ট ১০ বছর পরে আবার সংসদে
পাঠায় ও বিরোধী দল নেতা নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনে পিকেআর ৩১টি আসনে জয়ী হয়ে বড়
বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এসময় তার সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
করলে মাহাথির মোহাম্মাদ বলেন, “সে (আনোয়ার ইব্রাহিম) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে ভালো হবে“।
যাইহোক ২০১৩ সালের
নির্বাচনে আমনোর (৪৭.৪%) চেয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট (৫০.৯%) বেশি পপুলার ভোট
পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি। এরপর সর্বশেষ নির্বাচনসহ প্রতিটি নির্বাচনে তার জোট
বেশি পপুলার ভোট পায়। ২০০৮ সালে সমকামিতার অসত্য অভিযোগ আনলে আবারও নির্দেোষ
প্রমাণিত হয়। কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় ভীতু হয়ে ২০১৪ সালে আবার সে অভিযোগ এনে দ্রুত
বিচার প্রক্রিয়ায় পাঁচ বছরের সাজা প্রদান করে কোর্ট।
জেলে থাকা অবস্থায়
মাহাথির মোহাম্মাদ বন্ধৃত্বের হাত বাড়ায়। পিকেআরের সাথে জোটের প্রস্তাব দেয় এই
শর্তে যে তারা সরকার গঠন করতে পারলে রাজার মাধ্যমে তার সাজা মওকুফের চেষ্টা করবে ও
দুই বছর পরে আনোয়ারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিবে। সকল বৈরিতা ও জুলুমের কথা ভুলে ও
অনেকের মান-অভিমান উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে সম্মতি দেয় আনোয়ার ইব্রাহিম। ২০১৮
সালের নির্বাচনে আনোয়ার-মাহাথিরের জোট সে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমনুকে
হারিয়ে ক্ষমতায় আসে। মাহাথিরের রানিংমেট হিসেবে ডেপুটি হন আনোয়ার ইব্রাহিমের
স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ, যিনি মালয়েশিয়ার প্রথম মহিলা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী। সরকার
গঠনের পরে চুক্তি মোতাবেক জেল থেকে বের করে আনোয়ার ইব্রাহিমকে। নির্বাচন করে আবার
সংসদে ফেরেন তিনি। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের দরুন দুই বছর শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে (২২
মাস) এসে তাদের জোট ভেঙ্গে যায়। আবার ক্ষমতার কাছাকাছি এসেও ছিটকে পড়েন তিনি।
পিকেআরের সদস্যদের দিয়ে খেলতে যেয়ে ও নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যেয়ে ক্ষমতা
হারায় মাহাথির মোহাম্মাদ।
আনোয়ার ইব্রাহিমের
দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য (এবারের নির্বাচনে সবাই ফেল করে) ও আমনুর প্রচ্ছন্ন
সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসে মুহিউদ্দীন ইয়াছিন। বিভিন্ন রফাদফার পরে নিজ দল বারসাতু
থেকে বহিস্কার হয় মাহাথির মোহাম্মাদ। গঠন করে নতুন দল। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দরুন নতুন প্রধানমন্ত্রী হন আমনুর ইসমাইল সাবরি। দলের
প্রেসিডেন্ট জায়েদ হামেদী (সাবেক ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী) ও তার সমর্থকদের চাপে
অগ্রিম নির্বাচন দিতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী সাবরি।
গত সপ্তাহের
নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফল করে আমনুর নেতৃত্বে বারসাতু জোট। জামানাত হারায়
মাহাথির মোহাম্মাদসহ তার ছেলে মুখরিজ মাহাথির। কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়
বিভিন্ন জোটের টানাপোড়ন, আলাপ-আলোচনা ও সর্বশেষ রাজার পরামর্শে আনোয়ার ইব্রাহিমের
নেতৃত্বে ঐক্য সরকার গঠন করার লক্ষ্যে আজ ২৪শে নভেম্বর বিকাল পাঁচটায় তার শপথ
অনুষ্ঠান হয়। বারবার ক্ষমতার কাছে যেয়েও ভিতর ও বাহিরের বিভিন্ন কারণে ছিটকে পড়লেও
২৪ বছর দুই মাস ২২ দিন পরে মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আনোয়ার
ইব্রাহিম। দীর্ঘ এই পথযাত্রায় কাছের অনেকে পর হলেও তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজাহর
ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, মনোবল ও লড়াই করার মানসিকতা আনোয়ারকে বারবার রাজনৈতিক মঞ্চে
ফিরিয়ে এনেছে। সহ্য করতে হয়েছে অনেক অপবাদ, গঞ্জনা ও মানুষের টিটকারী। অথচ যিনি
আনোয়ারকে বহিস্কার করেন, তিনিই আজ জনগণ কর্তৃক বহিস্কৃত। আকাশসম জনপ্রিয় মাহাথির
মোহাম্মাদের যখন শেষ, ৭৫ বছরি ছয় সন্তানের জনক আনোয়ার ইব্রাহিম তখন যুদ্ধজয়ী বীর।
তাঁর এই অসম সংগ্রাম ও ধৈর্য্য সাহস যোগাবে অনাগত প্রজন্মের যে “জেতার আগে হারতে
নেই“।
Leave a reply