---মুহাম্মদ
হাবিবুর রহমান
১.
গঙ্গাঋদ্ধি
থেকে বাংলাদেশ গ্রন্থে লেখক খ্রীস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের
ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যদিও প্রথম সংস্করণে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত
ইতিহাস ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির সহায়তায় ২০০৭ সাল পর্যন্ত
ঘটনাপ্রবাহও লেখক সর্বশেষ সংস্করণে সংযুক্ত করেছেন। লেখকের তথ্যানুযায়ী আমরা
বর্তামানে যে বাংলাদেশে বসবাস করছি এই ভূখন্ডই একসময় গঙ্গাঋদ্ধি নামে পরিচিত ছিল।
পরবর্তীতে ইতিহাসের কালক্রমে তা আজ বাংলাদেশ হয়ে দাড়িয়েছে।কিন্তু ইতিহাসে
গঙ্গাঋদ্ধি এতটা আলোচনায় আসেনি। সমগ্র বইটিতে লেখক এই ইতিহাসের ধারাটাকে তুলে ধরার
চেষ্টা করেছেন। বইটির দুইটি ভাগ। প্রথম ভাগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাস বিধৃত হয়েছে
এবং পরবর্তী ধাপে লেখক ১৯৪৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কাহিনি লিখেছেন এবং এ অংশের নাম
দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
২.
প্রথম
ভাগঃ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০- ১৯৪৭)
আবুল
ফজলের মতে প্রাচীনকালে বঙ্গের রাজারা ১০ গজ উচু আল নির্মাণ করতেন, আর সেই আল থেকেই
বাঙ্গাল নামের উৎপত্তি। আর সেই বাঙ্গালদের দেশ আরবি ফারসিতে বাঙ্গাল হিসেবে রুপ
নিল।
১৩৪৫-৪৬
সালে ইবনে বতুতা বাংলাদেশে আসেন শাহজালালের সাথে দেখা করতে। বাংলার বন্দর গন্জ,
ব্যবসা বানিজ্য, জিনিসপত্র, দাসদাসীর সস্তা দাম, নদীতীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকে
মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু বর্ষা বন্যা ও কাদাপানি দেখে বিরক্ত হয়ে তিনি এদেশের নাম
দিয়েছিলেন ধনসম্পদপূর্ণ নরক।
৩.
ইতিহাসে
শের খান ও হুমায়ুন এক নাটকীয় নাম৷ একই মুদ্রার দুই পিঠ ছিলেন দুজন। শের খান
বিহারের নাবালক শাসনকর্তা জালাল খান লোহিনির অভিভাবক ছিলেন। পানিপথের যুদ্ধের পর
তার বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তার জায়গির দখল করে নেয়। পরবতীতে তিনি বাবরের বশ্যতা
স্বীকার করে জায়গির ফিরে পান। এদিকে জালাল খান লোহিনী শের খানের অভিভাবকত্বে
বীতশ্রদ্ধ হয়ে গৌড়ে মাহমুদের সাথে যোগদান করেন। তারপর হয় আরও নাটকীয় ঘটনা। ১৫৩৪
সালে জালালুদ্দিন লোহিনী ও মাহমুদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন শের খান৷ এরপরে
মাহমুদ পর্তুগীজদের সাহায্যের আাশায় তাদেরকে চট্টগ্রামে ঘাঁটি নির্মাণ করার অনুমতি
দেন, পরবর্তীতে এই ঘাটি উৎখাত করেন বর্তমান লালবাগ কেল্লার সুবেদার শায়েস্তা খান,।
সে আরেক ইতিহাস।
এরপর শের
খান একেককরে গৌড় দখল করে নিয়ে যান। দূর্বলচেতা মাহমুদ প্রচুর ধন সম্পদের বিনিময়ে
শের খানের সাথে সন্ধি করেন। কিন্তু বিহারে ফিরে গিয়ে শের খান আরও বহু অঙ্কের
নাজরানা দাবি করলেন যা দিতে মাহমুদ অস্বীকার করলে শের খানের পুত্র জালাল খান গৌড়
দখল করে তা জালিয়ে দেন। ১৫৩৮ সালের ৬ এপ্রিল গৌড়ের পতন হয়। এ ঘটনায় মাহমুদ পালিয়ে
গিয়ে সহজ সরল সম্রাট হুমায়ুনকে গৌড় আক্রমণ করার অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে বাংলা তথা
গৌড়ের সৌন্দর্যের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন গৌড়ের নাম রাখেন জান্নাতাবাদ।
এরপর
হুমায়ুন বেশিদিন টিকতে পারেনি। কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাকে ভারত ছাড়তে হয়েছে।
শের খান শের শাহ নাম ধারন করে বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করতে শুরু করেন। কিন্তু
চট্টগ্রাম ছিল মাহমুদের কর্মচারী ও পতুগীজদের দখলে।
৪.
এরপর
মোগলদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আফগানরা দলে দলে সোলাইমানের রাজ্যে
অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে এবং সোলাইমানের একজন সেনাপতি ছিলো কালাপাহাড় যিনি কিনা একসময়
ব্রাহ্মণ ছিলো পরবর্তীতে মুসলিম হন। এই দুর্ধর্ষ সেনাপতি নাকি বহু মন্দির, ও
দেবমূর্তি ধ্বংস করেন যদ্দরুন তার নামটি আজও সংস্কারবাদীরা সাহসের প্রতীক হিসেবে
ব্যবহার করে আসছে।
এভাবেই
করে ভারতবর্ষে আফগান শাশক দাউদ খানকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠিত হয় মোগল শাসন এবং ১৫৭৫
থেকে ১৭১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ জন মোগল সুবেদার বাংলা শাসন করেন। কিন্তু মোগলদের
প্রথমদিকের শাসন খুব সুখে কাটেনি। কর্মচারীদের বেতন রাস, নির্যাতন, আকবরের দীন ই
ইলাহির বিরুদ্ধে জৈনপুরের কাজিদের দেওয়া ফতোয়ায় মোগল শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের
দানা বাধতে শুরু করে। যেসব জমিদারেরা প্রথমে মোগলদের অধীনতা মেনে নেয়নি তারাই
ইতিহাসে বারো ভুইয়া নামে পরিচিত ছিলেন এবং এদের প্রধান ছিলেন ঈশা খান৷ লেখকের মতে
বারো ভুইঁয়াদের প্রতি আমাদের একটু স্বজনপ্রীতি আছে, তারা কোনো আদর্শ নিয়ে বিদ্রোহ
করেনি বরং আমাদের অঞ্চলের হওয়ায় আমাদের একটা টান আছে তাদের প্রতি। আর ইতিহাসে তারা
বারোভুঁইয়া নামে পরিচিত হলেও সংখ্যায় ছিলেন তারা আরও বেশি। আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর
এর সময় বাংলাদেশের সুবেদার ইসলাম খান চিশতী বারোভুঁইয়াদের সম্পূর্ণরুপে দমন করেন
এবং যশোরের প্রতাপাদিত্যসহ অনেকেই সেচ্ছায় মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মূলত
বারোভুঁইয়াদের উপর কড়া নজরদারি রাখার জন্যই ইসলাম খান বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে
ঢাকায় আনেন এবং ঢাকার নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর।
যাইহোক
সুবেদার শায়েস্তা খান যিনি কিনা সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা বা মাতুল ছিলেন তিনি
বাংলা অঞ্চলে মোগল শান্তি ফিরিয়ে আনেন এবং তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম অঞ্চলের দখল ছিলো
প্রায় আরাকানি মগদের হাতে। এবং মগরা এবং পর্তুগীজরা মিলে চট্রগ্রামে ব্যাপক
লুটতরাজ চালাত। ওখান থেকেই মূলত অরাজকতা বলতে বাংলায় মগের মুলুক বলা হয়। বিষয়টা
খুবই ইন্টারেস্টিং।
৫.
ইতিহাসে
আমরা বর্গীর আক্রমণের কথা জানি, কিন্তু সময়কালটা ও ইতিহাসটা জানি না। এটা ছিল ঠিক
নবাবী আমলের শেষ দিকের মুর্শিদ কুলি খানের সময়কালে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত।
মারাঠা সরকারের অস্ত্র সজ্জিত নিম্ন শ্রেনীর সৈন্যদের বারগীর বলা হতো। দশ বছর ধরে
বারগীরদের অত্যাচার, হত্যা, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগকে ইতিহাসে বর্গীর হাঙ্গামা নামে
পরিচিত।
ইতিহাসের
আরও এক মোড়কে লেখক লিখতে লিখতে ফুটিয়ে তুলেছেন তা হলো অন্ধকুপ হত্যা। শওকত জঙ্গকে
আমরা জানি, যিনি ছিলেন আলীবর্দি খার বড় মেয়ের ছেলে আর সিরাজ ছোট মেয়ের ছেলে। শওকত
জঙ্গ অলওয়েজ চেয়েছিলেন শাসক হতে। কিন্তু আলীবর্দি খান নির্বাচন করলেন
সিরাজউদ্দৌলাকে। এ ঘটনা মানতে পারেননি শওকত জঙ্গ। তিনি ইংরেজদের সাথে হাত মিলালে
তরুন নবাব সিরাজ খুব দ্রুত বিদ্রোহ টের পেয়ে চলে আসেন রাজধানী মুর্শিদাবাদে। এসেই
তিনি প্রথমে ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি এবং পরে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ দখল করেন। সাথে
সাথেই ইংরেজদের অস্থায়ী গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করল এবং কিছু ইংরেজ পালিয়ে যায়।
আর অবশিষ্ট কিছু উশৃংখল ইংরেজরা রাতে বিশৃঙ্খলা পাতালে তাদেরকে ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪
ফুট ১০ ইঞ্চি ঘড়ের মধ্যে আটকানো হয়। হলওয়েলের মতে তারা ছিল ১৪৬ জন। জুন মাসের গরমে
২৩ জন ছাড়া নাকি বাকি সবাই মারা যায়, ইতিহাসে যা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত।
৬.
এরপর
নাববী শাসন নিয়ে লেখক বিস্তারিত লিখেছেন। নবাব সিরাজ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন যেদিন
পরাজিত হয় তখন নবাবের শিবিরে সৈন্য ছিল ৫০ হাজারের মতো আর ক্লাইড যুদ্ধ করেছেন
মাত্র ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে। কারনটা আমাদের সবারই জানা কেন সেদিন নবাবকে পরাজিত হতে
হয়েছে। বীরত্বের মহিমা হচ্ছে মোহাম্মদী বেগকে আলীবর্দি খাই বড় করে রাজ প্রাসাদে
রেখেছিলেন কিন্তু সেই মোহাম্মদী বেগই নবাবের গায়ে শেষ ছুরিকাঘাতটা করেছিলেন। এরপর
মীর জাফর যখন নবাবের স্তী লুৎফুন্নেসাকে হেরেমে আসার প্রস্তাব দিলে বেগম তখন বলেন,
"একবার যে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে সে কখনও গাঠার পিঠে চড়তে পারে না"।
ধর্ম ও
সংস্কৃতি
মৌর্য
যুগে ব্রাম্যণ্যবাদের উত্থান হয়। গুপ্তযুগে সমাজের উচ্চস্তরে ছিল বেদিক ধর্ম ও
সাধারণে পৌরাণিক ধর্মের প্রসার হয়। মধ্যযুগে হিন্দু ধর্ম মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে
হিন্দু জমিদার ভূস্বামী ও রাজস্ববিভাগের কর্তাদের হাত ধরে। একইভাবে গৌড় সমাজের
প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় হিন্দু ধর্ম সম্প্রসারণ ঘটে।
এরপর লেখক
এখানে আরও বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
৭.
দ্বিতীয়
ভাগঃ (১৯৪৭- ২০০৭)
এ অংশে
লেখক আসলে তার পাঠ্য এবং বাস্তব জীবন থেকে ইতিহাসকে নিগূঢ়ভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৪৭
থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে বঙ্গবন্ধুর একটা
প্রতিউত্তর যা তিনি কবিগুরু রবিঠাকুরকে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন ১০ ই জানুয়ারি
১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি আবেগাপ্লুত ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে
রেসকোর্স ময়দান পৌছুতে আড়াই ঘন্টা লেগেছিল। এরপর সম্মিলিত জনতা যখন তাকে বক্তৃতা
দিতে বলেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন আমি আজ বক্তব্য দিতে পারব না। তিনি বললেন কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ বলেছিল, " সাত কোটি বাঙালির হে বঙ্গজননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ
করোনি।" কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে আমরা আজ মানুষ। এভাবে লেখক এ
অংশে ৭১, ৭৫, জিয়া আমল, এরশাদ, আইন, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন, জনমত, জনসংযোগ সব
বিষয় নিয়েই মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা করেন।
৮.
পর্যালোচনাঃ
সবশেষ বলব
যদি কেউ ইতিহাসের আলোকপাতা গুলো একবার ঝালাই করে নিতে চায় তার জন্য বইটা সুখপাঠ্য
হবে। প্রথম দিকে ৩০/৩৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আমারও পড়তে ভালো লাগেনি কিন্তু পরবর্তীতে
বেশ মজা পেয়েছি। লেখক বইয়ের মধ্যে বেশ তথ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে তবে আমার কাছে মনে
হয়েছে ইতিহাসের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোও ছিলো যেগুলো এ বইতে আসলে হয়ত ভালো
হতো যখন এর থেকেও নরমাল কিছু বিষয় চলে এসেছে। সবমিলিয়ে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি
বিশ্লেষকদের জন্য বলতে পারি বইটি বেশ সুখপাঠ্য হবে আশা করি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে
বইয়ের মধ্যে লেখক কয়েক পৃষ্ঠা ব্যাপি ঘটনাপ্রবাহের একটা চার্ট দিয়েছে, আর পৌরাণিক
ছবি এড করেছে এটা বইয়ের একটা আলাদা বিশেষত্ত। এই ছবিগুলোও বই থেকে নেওয়া।
[লেখকঃ
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একসময় বাংলাদেশ তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন
এবং বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছেন। রাজনীতির আড়ালেও তিনি
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। যেই পরিচয়টা অনেকেই জানেন
না। এছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, বর্তমানে আরও বেশি লিখছেন।]
প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমি
প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫
Leave a reply