দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ৬৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের দেশটি মাথাপিছু আয়, সাক্ষরতার হার, কর্মসংস্থানে এশিয়ায় বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। অথচ বর্তমান দেশটির পরিচয় অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হিসেবে। শ্রীলঙ্কার ৯০ শতাংশ মানুষ এখনো চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে। সরকার পরির্তন হলেও বিগত বছরগুলোতে শুরু হওয়া খাদ্য, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও ওষুধ সংকট এখনো কাটেনি। শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে প্রধানত করোনা মহামারি মনে করা হলেও বস্তুতপক্ষে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, সরকারের অদূরদর্শীতা, স্বজনপ্রীতি এবং জনতুষ্টিনীতিসহ আরো কিছু বিষয় দায়ী। তবে সংকট অতিক্রম করে ভারত, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মতো শ্রীলঙ্কা নিজেদের নতুন করে গড়ে তুলতে পারে। আবার ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো ‘ডমিনো ইফেক্ট’ বিদ্যমান সংকটকে ঘনীভূত করতে পারে।
বহুজাতিক রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ স¤প্রদায় সিংহলি আর অন্যতম প্রধান সংখ্যালঘু তামিল। স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে তামিলরা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) সংগঠনের মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ চলে। গৃহযুদ্ধ অবসান হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের জয়ের মাধ্যমে যার নেতৃত্ব দেন প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবার। ২০০৫ সালে মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে গৃহযুদ্ধ স্থায়ী অবসানের প্রতিশ্রæতি দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আপন ভাই গোতাবায়া রাজপাকসকে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এভাবে শ্রীলঙ্কায় পারিবারিক শাসন শুরু হয়। ১০ বছর শাসন করা মাহেন্দ্রা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে রনিল বিক্রমাসিংহের কাছে পরাজিত হন তিনি। এরপর ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে বড় ভাই গোতাবায়াকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করান এবং নির্বাচনে জয়ী হন। পরিবারতন্ত্রের প্রকৃত চেহেরা প্রকাশ শুরু হয় এবার। গোতাবায়া রাজাপাকসে মাহেন্দ্রাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন, গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ মন্ত্রণালয় ভাগ-বাটোয়ারা করে দেন পাঁচ ভাইয়ের মাঝে। রাজাপাকসে পরিবার নিজেদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা ঢাকতে অপরিকল্পিত নীতি গ্রহণ করে। চীন থেকে দ্বিপাক্ষিক ঋণের মাধ্যমে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। লোটাস টাওয়ার, কলম্বো পোর্ট সিটি উন্নয়ন প্রকল্প, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর, মাত্তালা রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ঋণের বোঝা বাড়ে সরকারের ওপর। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলো কর হ্রাস, ভর্তুকি প্রদান, কম মূল্যে চাল ও রুটি প্রদানের প্রতিশ্রæতি দিয়ে ক্ষমতায় আসতো। এসব প্রতিশ্রæতি পালন করতে গিয়ে মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপসহ ঋণের বোঝা বাড়ে। বিশাল ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার গণহারে টাকা ছাপায় যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে।
আমদানি নির্ভর শ্রীলঙ্কার রপ্তানি পণ্য বিস্তৃত নয়। রিজার্ভ সংকটে দেশটির আমদানি পণ্য বন্ধ হয়ে যায়, ফলে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সংকট শুরু হয়। অর্গানিক ফসল উৎপাদনের নামে সার ও কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও এর মূল লক্ষ্য ছিল হাতে থাকা সামান্য রিজার্ভ রক্ষা করা কিন্তু এতে কৃষি ব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবছর গড়ে যেখানে ৩০০ মিলিয়ন কেজি ফসল উৎপাদন হতো তা অর্ধেকে নেমে আসে। চালের উৎপাদন কমে যায় ৫০ শতাংশে ফলে সরকার চাল আমদানি করতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ৮ শতাংশ যার বেশির ভাগই আবার আসে চা হতে। একদিকে অর্গানিক চা উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি অন্যদিকে শিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার রাশিয়ার ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ; এটা রপ্তানিকে ব্যাপক ধাক্কা দেয়।
শ্রীলঙ্কার সংকট দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর দরজায় কড়া নাড়ে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই ঋণের প্রবাহ বজায় থাকে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিই ২ থেকে ৩টি খাতের ওপর নির্ভরশীল যা ঝুঁকিপূর্ণ। পর্যটন শিল্পের ওপর শ্রীলঙ্কার জিডিপি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি এই খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর অতি নির্ভরশীল। করোনা পরিস্থিতিতে ক্রয় আদেশ (অর্ডার) কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয় কমে যায়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঝুঁকি এড়াতে গার্মেন্টস শিল্পের পাশাপাশি ভারি শিল্পের ওপর মনোযোগ দেওয়া তথা রপ্তানিখাত বহুর্মূখী করা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর হাতে রয়েছে বহুমুখী অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন একদিকে সময় সাপেক্ষ, আরেকদিকে প্রয়োজন বিশাল আকারের বাজেট। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পগুলো কতটুকু উপযোগিতা বয়ে আনবে তা হিসেবের জন্য প্রয়োজন বিচক্ষণতা ও সুক্ষ্ণ পরিকল্পনা। অনুৎপাদনশীল প্রকল্পে শ্রীলঙ্কার বিপুল বিনিয়োগও দেশটির বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এ কারণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আগে বাস্তবসম্মত হিসাব গ্রহণ ও সময়সীমা সঠিকভাবে অনুমান করা জরুরি।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকলেও এর ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি ভাববার বিষয়। আন্তজাতিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চে রপ্তানি বৃদ্ধি হার ছিল ৩৩.৪ শতাংশ যেখানে আমদানি বেড়েছিল ৪৬.৭ শতাংশ এবং প্রবাসী আয় ১৭.৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত রয়েছে ৩৮ শতাংশ, যেটি এখনো স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে উচ্চ সুদে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্রæতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দুর্নীতিমুক্তি ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
Leave a reply