Sept. 27, 2024, 7:09 p.m.
None

তালেবানের উত্থানে আমেরিকা পরবর্তী আফগানিস্তানের ভবিষ্যত বুঝতে হলে আফগান ছাড়াও তার পাশ্ববর্তী ইরান, পাকিস্তান, চায়না ভারত এই চারটি দেশের ওপরেও নজর রাখতে হবে। দেশসমূহের নতুন নতুন গৃহীত পদক্ষেপের ওপর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চারটি দেশের যে কোন ছোট্ট একটি পলিসি আফগানিস্তানের ভবিষ্যত অস্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট। আবার তালেবানের কৌশলগত ছোট্ট একটি ভুলের কারণে অঞ্চলে অশান্তি বিরাজ করতে পারে যুগের পর যুগ। পাশ্ববর্তী দেশ ছাড়াও শক্তিশালী বিশ্বস্ত মিত্র প্রয়োজন রয়েছে তালেবানের। আফগান ঘিরে পাশ্ববর্তী প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে সুনির্দিষ্ট স্বার্থ। কোনো পরাশক্তি একটি ফ্রন্টে পরাজিত হওয়া মানে তার সকল শক্তি শেষ হয়ে যাওয়া নয়। দ্বিতীয় কোনো দেশের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই পরাশক্তি আমেরিকা। গত দুই দশকে খালি চোখে আমরা যা দেখছি তা আমেরিকার পরাজয়। আর যা দেখছি না, তা হয়তো আগামী দশকে প্রমাণ করবে আমেরিকারবিজয় ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত-ভিয়েতনামের সাথে আমেরিকার পরাজয়ের পর কে ভেবেছিল পরবর্তী ১৫ বছরে সোভিয়েত ইউনিয়ন হারিয়ে যাবে? তাই সহজেই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা খুবই কঠিন।

২০২০ সালের ২০ অক্টোবরে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে ঊধংঃ ঞঁৎশবংঃধহ ওংষধসরপ গড়াবসবহঃ (ঊঞওগ)-কে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেন। আমেরিকা মনে করে ইটিআইএম একটিস্বাধীনতাকামী দেশ প্রেমিক সংগঠন নিজেদের অধিকার, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তাদের সংগ্রাম। আমেরিকার সাথে তাল মিলিয়ে ইটিআইএমকে ভারতও স্বাধীনতাকামী সংগঠন মনে করে। আমেরিকা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার মধ্যেও আফগানিস্তান ইটিআইএমের জন্য সেফ-হেভেন ছিল।গেøাবাল জিনজিয়াংআন্দোলনের অন্যতম অংশীদার এই ইটিআইএম বা ঊধংঃ ঞঁৎশবংঃধহ ওংষধসরপ গড়াবসবহঃ। জিনজিয়াংয়ে বিভিন্ন অভিযান (অপারেশন) পরিচালনা করে তারা আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়। চীন আফগানিস্তানের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার যার সম্পূর্ণই ওয়াখান করিডর ঘিরে।ওয়াখান করিডরশুধু আফগানিস্তানের জন্য নয়, বরং অঞ্চলের সব দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ভৌগোলিকভাবে ওয়াখান করিডর হলো আফগান বাদাখশান প্রদেশের অন্তর্গত যার একদিকে তাজিকিস্তানের গর্নো-বাদাখশান, আরেকদিকে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের গিলগিট বাল্টিস্তান খায়বার পাকতুনখোয়া প্রদেশ। আফগানিস্তানে অবস্থিত ৩৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াখান করিডর যেমনিভাবে চীনের সাথে সীমান্ত তৈরি করেছে, তেমনিভাবে মধ্যএশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়াকেও বিচ্ছিন্ন করেছে। ওয়াখান আরও দুই দেশ তাজিকিস্তান পাকিস্তানের মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে। পরাশক্তিদের মধ্যে এই করিডর যুগের পর যুগ বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

 

তাজিকিস্তান পাকিস্তানের সাথে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। জিনজিয়াং প্রদেশের সাথে বিতর্কিত অঞ্চল আক্সাই চীনের ওপর বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে ভারতও এই অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে। এছাড়া চীনের জিনজিয়াংয়ের সঙ্গে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তানের  সীমানা রয়েছে। এদের মধ্যে পাকিস্তান তাজিকিস্তান চায়নার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় জিনজিয়াং বিষয়ে তারা কখনো হুমকির কারণ নয়। তবে আমেরিকার শেকল থেকে বেরিয়ে আসা আফগানিস্তান বরাবরই চীনের জন্য হুমকি ছিল। কারণ, আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডরকে ইটিআইএম গেরিলা সংগঠন জিনজিয়াং আন্দোলন বেগবান করার জন্য ব্যবহার করছে।

 

তালেবানের বিরুদ্ধেও ইটিআইএমকে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকা-তালেবান চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আফগানিস্তানের মাটিকে তালেবান কখনো অপর দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না। বিশেষ করে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা আইএসকে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তবে ইটিআইএম আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডর ব্যবহার করে চীনে আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র নারাজ হবেন না। কারণ, আমেরিকার দৃষ্টিতে ইটিআইএম এখন আর সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।

চীনের সবসময় ভয়ের কারণ জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলন বা গেøাবাল জিনজিয়াং মুভমেন্ট। আর আন্দোলনে বিদেশি শক্তির সহযোগিতা প্রাপ্তির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইটিআইএম সংগঠন আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডর। সমগ্র আফগান নিয়ে চীনের যতটা না মাথা ব্যথা, তার চেয়ে বেশি চিন্তা ক্ষুদ্র ওয়াখান করিডর ইটিআইএম গেরিলা সংগঠন নিয়ে। তাইতো আমেরিকা পরবর্তী যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসলে চীন তার সাথেই সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চায়নার কাছে তালেবান বা আশরাফ ঘানি মূখ্য বিষয় নয়, তাদের কাছে জিনজিয়াং প্রদেশের অখÐতা নিরাপত্তাই আসল বিষয়।

এজন্য তালেবানের উত্থানে চীন যতটা আনন্দিত, ঠিক ততটাই আতঙ্কিত। বেইজিং জানে আফগান তালেবানের সঙ্গে যতই সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক না কেন, খেয়ালি (আনপ্রেডিক্ট্যাবল) বন্ধু তালেবান যেকোনো সময় শত্রæ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। কারণ, ধর্মীয় স্বার্থে এই তালেবান ২০০১ সালে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে সৌদি-আমেরিকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। অথচ সৌদি-আমেরিকা পাকিস্তানের সহযোগিতায় সোভিয়েত রাশিয়াকে তাড়িয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল আফগান মুজাহিদীন, পরবর্তীতে তালেবান। তাই যতদিন ওয়াখান করিডরে চীন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে না পারছে, ততোদিন তালেবান নিয়ে তাদের মনে  আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

২০১৮ সালে কাবুল সরকারের কাছে ওয়াখানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে আগ্রহ দেখায় চীন। এর মাধ্যমে চায়না ইটিআইএম আইএসকে প্রতিহত করা ছাড়াও তাদের ঐতিহাসিক সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। মূলত এর মাধ্যমে চীন এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। কাবুল প্রশাসন ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেও ন্যাটো জোটের বাধার মুখে বেইজিং তখন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফল হয়নি। সে কারণে বর্তমান তালেবানের ওপর ভর করে চীন চাইছে তার নতুন অর্থনৈতিক করিডর সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে। এর মাধ্যমে জিনজিয়াংয়ের নিরাপত্তা আঞ্চলিক আধিপত্য দুটোই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তালেবানকে স্বীকৃতি (প্রকাশ্যে দেয়নি তবে তালেবানের সঙ্গে কাজ করছে) দেওয়ার মাধ্যমে সে পথেই হাঁটছে চীন। তবে তালেবান সুন্নি উইঘুর মুসলিম স্বার্থকে সহজেই জলাঞ্জলি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার জন্য চীনের সাথে সাময়িক

 সুর মিলাবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।

মূলত তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে অঞ্চলে পাকিস্তানের মত আফগানিস্তানেও আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ খুঁজছে চায়না। এতদিন ন্যাটো নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানকে বাদ রেখেইনিউ সিল্ক রোডনিয়ে চিন্তা করতে হয়েছিল চীনকে। এখন আফগানিস্তান ব্যবহার করে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অনেকটাই সহজ হবে। শুধু সহজই নয়, বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন অনেক সুযোগ তৈরি করতে পারবে তারা। এক আফগান ব্যবহার করে চীন স্থলপথে বিআরআই সমুদ্র পথে মেরিটাইম সিল্ক রোডের সুবিধা ভোগ করতে পারবে। আফগানিস্তানের মাধ্যমে তারা ইরানে এক্সেস পাবে যেখানে অতীতে বেইজিংয়ের মধ্য এশিয়া ঘুরে তেহরানে আসতে হতো। এর মাধ্যমে শুধু সময় দূরত্বই কমবে না, ইরানের চাবাহার, বুশেহর নাশেহরের মত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে চায়না। পাকিস্তানের গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে শুধু আরব সাগরের প্রবেশ পেত চায়না। অদূর ভবিষ্যতে আফগান হয়ে ইরানের সব বন্দরের মাধ্যমে আরব সাগরের পাশাপাশি পারস্য উপসাগর মধ্য এশিয়ায় কাস্পিয়ান সাগরের এক্সেস পেতে পারে তারা। এর মাধ্যমে ইরান যেভাবে সহজেই তার অপরিশোধিত তেল চীনে রপ্তানি করতে পারবে তেমনি চায়না একই সাথে ইরানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে খুব সহজেই তাদের বাণিজ্যিক সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে।

 

প্রশ্ন আসতে পারে আফগানিস্তান কতটা সুযোগ দিবে চীনকে? স্থলবেষ্টিত দেশটিকে অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে চায়নার মাধ্যমে না হলেও নিজ উদ্যোগে ইরানের সাথে সমঝোতা করতে হতে পারে। সামুদ্রিক বাণিজ্যে আফগানিস্তানের জন্য ইরানের বন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও আফগানিস্তান চাইলে স্থল পথে মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সবাইকে যুক্ত করতে পারে অথবা পাকিস্তানের গোয়াদার গভীর সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমেও বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

একসময় সড়ক পথে ৬৫০০ কিলোমিটার সিল্ক রোডের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল চীনের। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে হান রাজবংশের আমলে সিল্ক রোড গড়ে ওঠে। চীন থেকে শুরু হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ বোখারা হয়ে তুরস্কের মধ্য দিয়ে তৎকালীন জার্মানির প্রুয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আন্তমহাদেশীয় সড়ক। রেশম বাণিজ্যের জন্য সড়ক পরিচিতি লাভ করলেও পরবর্তীতে অন্যান্য বাণিজ্যের জন্যও এটি ছিল অদ্বিতীয়। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক দশম শতাব্দীতে চীনের সাং রাজবংশের আমলে বন্ধ হয়ে যায়। এটি নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। নতুন সিল্ক রোডের উদ্যোক্তা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর উদ্দেশ্য মহাদেশব্যাপী যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল করিডর প্রতিষ্ঠা করা। এর আওতায় রয়েছে ৬৮টি দেশ ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। ভারত মহাসড়কের বিরোধীতা করলেও ইতোমধ্যে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে উদ্যোগ আরও দ্রæততর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। হান রাজবংশের গড়া সিল্ক রোড শি জিনপিং এর নয়া সিল্ক রোড (বিআরআই) এর ধারণা অনেকটাই ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর নয়া সিল্ক রোড শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য রক্ষা করবে না, পাশাপাশি সামরিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারেও সহযোগিতা করবে। এছাড়াও মেরিটাইম সিল্ক রোডের মাধ্যমে স্থল সড়কের পাশাপাশি সামুদ্রিক মহাসড়কের মাধ্যমে উভয় দিক দিয়ে সুবিধা পাবে তারা। যেন একই সাথে হার্টল্যান্ড রিমল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে শি জিনপিং এর মহা কৌশল।

 

ডযড় ৎঁষবং ঊধংঃ ঊঁৎড়ঢ়ব পড়সসধহফং ঃযব ঐবধৎঃষধহফ; যিড় ৎঁষবং ঃযব ঐবধৎঃষধহফ পড়সসধহফং ঃযব ডড়ৎষফ-ওংষধহফ; যিড় ৎঁষবং ঃযব ডড়ৎষফ-ওংষধহফ পড়সসধহফং ঃযব ড়িৎষফ. ” — গধপশরহফবৎ (১৯০৪)

 

১৯০৪ সালে বৃটিশ ভূগোলবিদ হালফোর্ড জন ম্যাকিন্ডার তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ঞযব এবড়মৎধঢ়যরপধষ চরাড়ঃ ড়ভ ঐরংঃড়ৎু এর মাধ্যমে ঐবধৎঃষধহফ ঞযবড়ৎু দিয়েছিলেন। সেই তত্তে¡ বলা ছিল, রাশিয়া মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ নিয়ে গঠিত হার্টল্যান্ড হচ্ছে পৃথিবীর পিভট এরিয়া। এই এলাকা যাদের দখলে থাকবে তারাই পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সেই ১৯০৪ সালে দাঁড়িয়ে এই কথা বিশ্বাস করানো খুবই কঠিন ছিল। কারণ সেই সময়কার বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র এই হার্টল্যান্ডের বাইরে ছিল আর তুরস্ক ছিল হার্টল্যান্ডের প্রান্তে। সর্বোপরি এই অঞ্চল তখন গরিব এবং অনুন্নত ছিল, শিল্পে পিছিয়ে, প্রধান পেশা ছিল কৃষি। কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাই ৭০ শতাংশ হার্টল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুধু তুরস্ক চায়না বাদে ম্যাককিন্ডারের সমস্ত হার্টল্যান্ড চলে যায় সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে। কমিউনিস্ট চায়না তখনকার কামাল পাশার আদর্শের তুরস্ক সোভিয়েত মুক্ত থাকলেওকমিউনিস্ট কমিউনিস্ট ভাই ভাইএর ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। চায়না, তুরস্ক সোভিয়েতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষি প্রধান হার্টল্যান্ড ধীরে ধীরে শিল্প প্রধান অঞ্চলে পরিণত হচ্ছিল।

অপরদিকে, আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নিকোলাস জন স্পাইকম্যান হার্টল্যান্ড তত্তে¡ বিপরীত তত্ত¡ নিয়ে এলেন। তিনি দিলেন জরসষধহফ ঞযবড়ৎু। তার বক্তব্য হচ্ছে, ইউরেশিয়ার হার্টল্যান্ড নয়, বরং হার্টল্যান্ডকে মালা বা রিমের মত ঘিরে থাকা রিমল্যান্ডই হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রক। যার কাছে এই এলাকার দখল থাকবে সেই পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে।ডযড় পড়হঃৎড়ষং ঃযব জরসষধহফ ৎঁষবং ঊঁৎধংরধ, যিড় ৎঁষবং ঊঁৎধংরধ পড়হঃৎড়ষং ঃযব ফবংঃরহরবং ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ. ”  --- ঝঢ়ুশসধহ

¯œায়ু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (১৯৪৫-৯০) স্পাইকম্যানের তত্তে¡ ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র রিমল্যান্ডের দখল নিতে এই এলাকার দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অর্থনৈতিক জোট করতে শুরু করলো, নৌবহর দিয়ে রিমল্যান্ড ঘিরে ফেললো এবং রিমল্যান্ডের বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাটি তৈরি করলো। বিভিন্ন কৌশলে পাকিস্তানের সহায়তায় চীনকেও সোভিয়েত বলয় থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে মার্কিন বলয়ে নিয়ে এলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন-আমেরিকার সেই সখ্যতা দেখেছে বিশ্ব।

১৯৯০ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় স্নায়ু যুদ্ধ। তখনকার সময়ে কেউ যদি মনে করে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে ম্যাকিন্ডারের হার্টল্যান্ড তত্তে¡ উপযোগীতা শেষ হয়ে গেছে, তাহলে সা¤প্রতিক সময়ে দেশসমূহের উন্নয়ন লক্ষ্য করলে তারা ভুল বুঝতে পারবে। হার্টল্যান্ড তত্তে¡ উপযোগীতা আমাদের চোখে ধরা না পড়লেও শি জিনপিংয়ের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে। তাই ২০১৪ সালে হার্টল্যান্ড তত্ত¡কে কেন্দ্র করে চীনের তিন মহাদেশীয় মহাসড়কওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডএর প্রস্তাবনা। অর্থাৎ হার্টল্যান্ড তত্তে¡ ম্যাকিন্ডার এখনো পরাশক্তিদের মাথায় বিরাজমান।

অন্যদিকে শুধু হার্টল্যান্ডকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে না চীনের পলিসি। সাথে রয়েছেন অধ্যাপক স্পাইকম্যান তার রিমল্যান্ড তত্ত¡ চীনের মেরিটাইম সিল্ক রোড এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চীন যেমন গোয়াদার, মালে, হাম্বানটোটা, কায়ুকফায়ু সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে আরব সাগর বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি দক্ষিণ চীন সাগরেও বেইজিং বহাল তবিয়তে থাকছে। ঐতিহাসিক সিল্ক রোড (বর্তমান বিআরআই) মেরিটাইম সিল্ক রোডের সমন্বয়ে একই সাথে ম্যাকিন্ডারের হার্টল্যান্ড স্পাইকম্যানের রিমল্যান্ড তত্তে¡ আলোকে এগিয়ে যাচ্ছে চায়না।

তালেবানের আফগানকে হাতে নিয়ে রিমল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ আফগানিস্তান ইরানকে সঙ্গী করে একই সাথে বিংশ শতাব্দীর দুটি লিডিং তত্ত¡ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে পুরো পৃথিবী লিড দিতে চায় চীন। তালেবানের আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের ষোলকলা পূর্ণ করা অনেকটাই সহজ হবে। তবে কতদিন আফগানের হাতে হাত রেখে কমিউনিস্ট চায়না এগোতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। চীনের যেমি আফগান মিশনের প্রবেশদ্বার ওয়াখান করিডর তালেবানেরও তেমন কাশ্মীর মিশনের সম্ভাব্য মাধ্যম ওয়াখান। আবার পাকিস্তানকে বাইপাস করে চীনের আরব সাগরে আসার নতুন করিডরও হতে পারে ওয়াখান। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপর ওয়াখান করিডরের প্রবেশ (এক্সেস) হারায় ভারত। যে কারণে কৌশলগতভাবে অঞ্চলে পাকিস্তান চায়না থেকে অনেক পিছিয়ে ভারত। বোঝাই যাচ্ছে অঞ্চলে ওয়াখানের গুরুত্ব অপরিসীম যা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মধ্য এশিয়ায় যেতে বা চীন থেকে আরব সাগরে ভিড়তে সহায়ক ভূমি। ওয়াখানের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অঞ্চলকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

পিটার হপকার্ক এর 'ঞযব এৎবধঃ এধসব ঙহ ঝবপৎবঃ ঝবৎারপব রহ ঐরময অংরধ' বইয়ের মাধ্যমে ওয়াখান বা তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান রাশিয়ান সম্রাজ্যের মধ্যবর্তী বাফার জোন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য ‘‘এন্টি কমিনটাম’’ এর ভূমিকা পালন করেছে এই করিডর। এর কারণে মধ্য এশিয়া পাড়ি দিয়ে অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি কমিউনিস্ট রাশিয়া বা কমিউনিজম। অঞ্চলকে ঘিরেই ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় নতুন গ্রেট গেম আবর্তিত হবে। পাকিস্তান, ভারত, চায়না, তাজিকিস্তান আফগানিস্তানের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা অনেকাংশেই নির্ভর করবে ওয়াখান করিডরের ওপর।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরপর গ্রেটার কাশ্মীর এর অন্তর্গত গিলগিট বাল্টিস্তান আজাদ কাশ্মীর যদি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না হতো, তাহলে চীনের পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে পারতো। চীন-পাকিস্তান করিডর নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে গিলগিট বাল্টিস্তানকে কেন্দ্র করে। গিলগিট পাকিস্তানের অধীনে না হয়ে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আরব সাগরে তরি ভাসানো দূরের কথা, চীনের মেরিটাইম সিল্ক রোডের স্বপ্ন অনেকটা কল্পনা থেকে যেত। চীনের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব গিলগিট বাল্টিস্তান ঘিরে। একই সঙ্গে গিলগিট হারানোর মধ্য দিয়ে অঞ্চলে গুরুত্ব হারিয়েছে ভারত।

দেশভাগের পর ভারত যদি গিলগিটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতো তাহলে চীনকে হয় ভারত অথবা আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডর হয়ে আরব সাগরে বাণিজ্য করতে হতো। এর মাধ্যমে ভারতের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত অক্ষণœ থাকতো। গত বিশ বছর আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রচুর বিনিয়োগ থাকা সত্তে¡ তাদের মধ্যে সীমান্ত না থাকায় সহজেই আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না দিল্লি। আজকের আফগানিস্তানে ভারতের পরাজয়ের মূলে রয়েছে ১৯৪৭ গিলগিট বাল্টিস্তানে পাকিস্তানের নিকট তাদের পরাজয়। আবার অঞ্চলে বর্তমান উত্থানের পেছনেও রয়েছে দেশভাগ পরবর্তী গিলগিট আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তানের বিজয়। তাই সর্বদা চীনের কাছে পাকিস্তান ছিল তুরুপের তাস। কিন্তু আফগান তালেবানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক ভবিষ্যত পাকিস্তানের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। জিনজিয়াংয়ের কাশগর থেকে শুরু করে গিলগিট বাল্টিস্তান বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে গোয়াদার বন্দরে চলে গেছে চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিসি) সা¤প্রতিক সময়ে বেলুচ স্বাধীনতা আন্দোলন তৎসংলগ্ন এলাকায় চীনা নাগরিক হত্যার ঘটনা চায়নাকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। চায়না তার বিকল্প নিরাপদ হিসেবে সিপিসি বাইপাস করে ওয়াখান করিডরের দিকে গুরুত্বারোপ করতে পারে। এতে চীনের কাছে গুরুত্ব কমে যাওয়ায় পাশাপাশি পাকিস্তান আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে পরবর্তী সমীকরণ নির্ভর করছে তালেবান চীনের মধ্যে সম্পর্কের ওপর। অদূর ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, তালেবানের উত্থানে যে চীন আজ আনন্দে আত্মহারা, সেই চীন একদিন তালেবানের কাছে জিনজিয়াং হারাবে। আবার যে তালেবানকে মুক্তির জন্য গত দুই দশক ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে আমেরিকার বিরুদ্ধে, সেই তালেবানকেই হয়তো যুগের পর যুগ চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হতে পারে। অপেক্ষা করতে হবে, সময়ই সব বলে দিবে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

Leave a reply